কম্পিউটার ভাইরাস কি

কম্পিউটার ভাইরাস কি?

সাধারণ বাংলায় বললে, একটি কম্পিউটার ভাইরাস হলো যে প্রোগ্রাম বা কোড নিজে থেকে হয়তো খোলা-সাঁকো না দিয়েই অন্য ফাইল, প্রোগ্রাম বা কম্পিউটারের কার্যপ্রণালীতে আলাদা হয়ে ঢুকে পড়ে এবং নিজের কপি তৈরি করতে পারে, কখনো কখনো ক্ষতি-করও হতে পারে।
যেমনভাবে জীবজীবন্ত ভাইরাস মানবদেহে সংক্রমণ ঘটায়, ঠিক তেমনিভাবে কম্পিউটার ভাইরাস কম্পিউটারে ঢুকে অন্যান্য ফাইল বা প্রোগ্রামের সঙ্গে মিশে সেখান থেকে ছড়িয়ে পড়তে পারে।

নিচে আমরা একটু বিস্তারিত আলোচনা করব—ভাইরাসের সংজ্ঞা-ব্যাখ্যা, কীভাবে কাজ করে, ভাইরাসের ইতিহাস, কিছু স্মরণীয় উদাহরণ এবং ভাইরাস থেকে কীভাবে নিজেদের রক্ষা করা যায়।

সংজ্ঞা ও কীভাবে কাজ করে

সংজ্ঞা

বিশ্বের অন্যতম বিশ্বাসযোগ্য উৎস Encyclopaedia Britannica বলছে:

“A virus consists of a set of instructions that attaches itself to other computer programs, usually in the computer’s operating system, and becomes part of them. … The infection can then transfer itself to files and code on other computers through memory-storage devices, computer networks, or online systems.”

এর সহজ বাংলা করলে বলতে হয়:

  • ভাইরাস নিজেই হয় একটি কোড যা অন্য কোনো প্রোগ্রামের সঙ্গে যুক্ত হয় বা যুক্ত করা হয়।

  • একবার যুক্ত হলে, যখন সেই প্রোগ্রাম চালু হয় বা লোড হয়, ভাইরাস সক্রিয় হতে পারে।

  • ভাইরাস তার নিজের কপি তৈরি করে অন্য ফাইল বা প্রোগ্রামকে “সংক্রমিত” করে।

  • সংক্রমণ হয়ে যাওয়া কম্পিউটার থেকে অন্য কম্পিউটারে, নেটওয়ার্ক বা ইউএসবি ড্রাইভ ইত্যাদির মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়তে পারে।

কীভাবে কাজ করে

ভাইরাস সাধারণত নিচের ধাপগুলো অনুসরণ করে:

  1. প্রবেশ – কোনো ফাইল, ইমেইল সংযুক্তি, ইউএসবি ড্রাইভ বা ডাউনলোড করা সফটওয়্যারের মাধ্যমে কম্পিউটারে আসে।

  2. সংযুক্তি – এটি হয়তো একটি সাধারণ প্রোগ্রামের সঙ্গে যুক্ত হয় (যেমন .exe, .com ফাইল) বা বুট সেক্টরের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে।

  3. সক্রিয়তা – যখন ওই প্রোগ্রাম চালু হয় বা বুট হয়, ভাইরাস সক্রিয় হয়।

  4. প্রচারণা/কপি তৈরি – ভাইরাস নিজের কপি তৈরি করে অন্য ফাইল বা সেক্টরে যুক্ত হয়।

  5. ক্ষতি বা ফলাফল – ভাইরাস কেবল নিজের কপি না ছড়িয়ে দিয়ে বিভিন্ন কার্যকরী ক্ষতি করতে পারে যেমন: ফাইল মুছে দেওয়া, স্লো করে দেওয়া, পার্সোনাল তথ্য চুরি করা ইত্যাদি।

উদাহরণস্বরূপ: একটি ভাইরাস হয়তো ইউএসবি ড্রাইভে গিয়ে ফাইলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাবে, এরপর অন্য কম্পিউটারে সেই ড্রাইভ লাগালে সেখানেও সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়বে।

ভাইরাসের সূচনা ও ইতিহাস

ভাইরাসের ইতিহাস দিনে দিনে গড়িয়ে এসেছে। নিচে কিছু মাইলফলক দেওয়া হলো:

  • ১৯৭০-এর দশকে গবেষণামূলকভাবে এমন কোড তৈরি হয়েছিল যা নিজে থেকে চলতো এবং অনুরূপ জীববৈচিত্র্য বোঝাতো—যেমন Creeper নামক প্রোগ্রাম।

  • ১৯৮৬ সালে পাকিস্তানে তৈরি Brain ভাইরাস প্রথম “ব্যবসায়িক” কম্পিউটারে দেখা গেছে। Wikipedia

  • পরবর্তী বছরগুলোতে ভাইরাস দ্রুত বাড়তে শুরু করে, মূলত যখন পার্সনাল কম্পিউটার ও ফ্লপি-ড্রাইভ জনপ্রিয় হয়।

  • একই সঙ্গে বলা যেতে পারে—ভাইরাস শুধুই মজা বা গবেষণার বিষয় থেকেও ক্রমে পায় দুষ্কৃতিকারী উদ্দেশ্য যেমন তথ্য চুরি, ব্যাবসার ক্ষতি করা, অর্থ লুণ্ঠন ইত্যাদি। The Australian

ভাইরাসের কিছু উদাহরণ

নিচে কিছু জনপ্রিয় (বা ভয়ঙ্কর) ভাইরাস ও ট্রোজান-প্রোগ্রামের উদাহরণ দেওয়া হলো।

১) Brain

Brain ভাইরাস ১৯৮৬ সালে তৈরি হয়। এটি IBM PC ও তার সমসংখ্যক মেশিনগুলোর বুট সেক্টর পরিবর্তন করেছিল।

এই ভাইরাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো—এর নির্মাতারা ভাইরাস তৈরি করে তাদের নাম-ঠিকানাসহ ফোন নম্বর ফ্লপি-ড্রাইভের বুট সেক্টরে রেখে দিয়েছিলেন।

২) Anna Kournikova Worm

Anna Kournikova নামের এই ওয়ার্ম ২০০১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইমেইল অ্যাটাচমেন্ট হিসেবে ছড়িয়ে পড়েছিল। ইউজারদের কৌতূহল দিয়ে একটি ছবির নাম দেওয়া হয়েছিল — কিন্তু আসলে এটি একটি ম্যালিশাস স্ক্রিপ্ট ছিল, যা ইনফেক্টেড মেসেজ প্রাপকের আউটলুক অ্যাড্রেসবুকে নিজেকে পাঠিয়ে দিত।

এটি সরাসরি অনেক ফাইল মুছে দেয়নি, তবে প্রচুর সিস্টেমে থ্ৰ্‌টল বা সমস্যা সৃষ্টি করেছিল।

৩) Conficker

Conficker হলো একটি ওয়ার্ম-ভিত্তিক ম্যালওয়্যার, যা ২০০৮ সালে প্রথম শনাক্ত হয়। এটি উইন্ডোজ সিস্টেমে নিরাপত্তার ফাঁক (vulnerability) ব্যবহার করে দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছিল এবং সারা বিশ্বের দিনে দিনে লাখো কম্পিউটারে সংক্রমণ ঘটেছিল।

৪) Sobig, Klez, Code Red

এইগুলো হলো ২০০০-এর দশকে ভয়ঙ্কর ভাইরাস/ওয়ার্ম যা শুধু ফাইল মুছে দেয়নি, বড় বড় কোম্পানি, সার্ভার ও নেটওয়ার্ককে লক্ষ‌্য করেছিল। যেমন: Sobig ভাইরাসের ক্ষতির পরিমাণ অনেক কোটি ডলারে পরিমাপ করা হয়েছে।

কেন এটি বিপজ্জনক?

কম্পিউটার ভাইরাসের বিপদ অনেকরূপী। নিচে কিছু কারণ দেওয়া হলো:

  • ডেটা মুছে দেওয়া বা করাপ্ট করা: ভাইরাস কোনো গুরুত্বপূর্ণ ফাইল মুছে দিতে পারে অথবা ফাইল করাপ্ট করে দিতে পারে যা সঠিকভাবে কাজ করবে না।

  • সিস্টেম স্লো বা হ্যাং হয়ে যাওয়া: ভাইরাস কার্যপ্রবাহী হয়, ফলে সিসটেম ধীর হয়ে পড়ে বা কাজ বন্ধ হয়ে যেতে পারে।

  • গোপন তথ্য চুরি: কিছু ভাইরাস ইউজারের পার্সোনাল তথ্য, পাসওয়ার্ড বা ব্যাংকিং তথ্য চুরির উদ্দেশ্যে তৈরি হয়।

  • অর্থনৈতিক ক্ষতি: কোম্পানি বা ব্যক্তিগতভাবে ভাইরাস-সংক্রান্ত সমস্যা মোকাবেলায় প্রচুর খরচ হয়। যেমন আগে উদাহরণ দেয়া Sobig-এর ক্ষেত্রে। HP

  • নিরাপত্তার বিশ্বাস হ্রাস: একবার ভাইরাস সংক্রমণ হলে প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি নিরাপত্তার বিষয়কে আরো গুরুত্ব দিতে হয়, যা সময় ও খরচ বাড়ায়।

নিজে কীভাবে নিরাপদ থাকব?

ভাইরাস থেকে বাঁচতে নিচের কিছু সহজ কিন্তু অত্যন্ত কার্যকরী নিয়ম মানা উচিত:

  1. অ্যান্টিভাইরাস সফটওয়্যার ব্যবহার করুন এবং নিয়মিত আপডেট করুন।

  2. সফটওয়্যার ও অপারেটিং সিস্টেম আপডেট রাখুন—নতুন সিকিউরিটি প্যাচ হলে দ্রুত ইনস্টল করুন।

  3. জানেন না এমন ইমেইল অ্যাটাচমেন্ট বা লিংকে ক্লিক করবেন না।

  4. ইনফেক্টেড ইউএসবি, ডিভাইস বা সফটওয়্যার থেকে সাবধান থাকুন।

  5. রেগুলারভাবে ডেটার ব্যাকআপ রাখুন। যদি ভাইরাস মুছে দেয়, তাহলে ব্যাকআপ থেকে পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হবে।

  6. বিশ্বাসযোগ্য উৎস থেকে মাত্র ফাইল বা সফটওয়্যার ডাউনলোড করুন। অননুমোদিত বা সন্দেহযুক্ত উৎস থেকে না।

  7. নেটওয়ার্ক-সিকিউরিটির বিষয়েও মনযোগ দিন। যেমন: ওয়েফায়ারওয়াল চালু রাখা, নেটওয়ার্ক শেয়ারিং সীমাবদ্ধ রাখা।


বিশেষ করে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট

বাংলাদেশেও কম্পিউটার ব্যবহার দ্রুত বাড়ছে—ব্যক্তিগত কম্পিউটার, স্মার্টফোন, অফিস কম্পিউটার সব জায়গায়। তাই ভাইরাস-থ্রেট আমাদের জন্যও প্রাসঙ্গিক। বিশেষ করে হয়তো নিম্নলিখিত বিষয়গুলো মনে রাখা জরুরি:

  • অফিস বা ব্যবসার কম্পিউটারে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংরক্ষিত থাকে। ভাইরাস দ্বারা সেই তথ্য ঝুঁকিতে পড়লে ব্যবসায়িক ক্ষতি হতে পারে।

  • সাধারণ ব্যবহারকারীরাও অননুমোদিত সফটওয়্যার বা ইমেইল অ্যাটাচমেন্ট খুলে ফেলেন, যা ভাইরাস-সংক্রমণের উৎস হতে পারে।

  • দেশে অনেক প্রতিষ্ঠান প্রয়োজনীয় তথ্য-প্রযুক্তি সুরক্ষায় মনোযোগ কম দিয়ে থাকে—এগুলো ভাইরাস বা ম্যালওয়্যার দ্বারা প্রবেশ করার সুযোগ দেয়।

  • তাই ব্যক্তিগত ও প্রতিষ্ঠানের পর্যায়ে সচেতনতা বাড়ানো জরুরি।


সংক্ষেপে

ভাইরাস শুধু একটি ‘ছোঁয়া’ বা ‘মজা’-র বিষয় নয়—এটি একটি বাস্তব সাইবার ঝুঁকি যা তথ্য, সময়, অর্থ সবকিছুর জন্য ক্ষতি করতে পারে।
প্রযুক্তি যত বাড়ছে, ভাইরাসের রূপ ও সুযোগও তত পরিবর্তন হচ্ছে—সুতরাং সচেতন থাকা ছাড়া হয়তো বাঁচা কঠিন হতে পারে।

আপনি যদি চান, তাহলে আমি “ভাইরাস, ওয়ার্ম ও ট্রোজান-এর মধ্যে পার্থক্য” নিয়ে একটি বিস্তারিত বাংলা আর্টিকেলও লিখে দিতে পারি, যাতে বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়। সন্দেহ থাকলে বলুন।

Scroll to Top